লালন এর মহৎ উদ্বেগ | ইমন জুবায়ের

লালন এর মহৎ উদ্বেগ | ইমন জুবায়ের

Metaphysical anxiety  বলে ইংরেজিতে একটা কথা আছে। কথাটা বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়- ‘অধিবিদ্যক উদ্বেগ’। তবে এভাবে বললে কথাটার মানে ঠিক পরিস্কার হয় না। আসলে ‘মেটাফিজিক্যাল অ্যাংজাইটি’ দুনিয়াদারি বিষয়ক উদ্বেগ নয়, বরং কি করে দুনিয়াদারি সম্ভব হল এবং কেন সম্ভব হল এবং আমার সঙ্গে এই দুনিয়াদারির কি সম্পর্ক-সে বিষয়ে উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা।
এ এক বিষম ব্যাধি।
মানবকূলের অল্পসংখ্যকই এ ব্যাধিকে ভোগে। যারা এ ব্যাধিতে ভোগে তাদের সমাজের মূলস্রোত কবি-দার্শনিক বলে সম্মান করলেও নিজেরা কিন্তু তফাতে থাকে। কেননা, এই ব্যাধিতে ভোগা লোকজনের বৈশিষ্ট্য খানিকটা উৎকেন্দ্রিক গোছের হয়। বাংলার লালনও স্বভাবে ছন্নছাড়া ছিলেন বৈ কী। প্রমাণ দিই। বাংলার সমাজ যখন প্রতিনিয়তই নারীকে পিষ্ট করার নানান ফন্দিফিকির করে তখন এই মহাত্মা ঘোষনা দিলেন-‘নারী হও। নারী ভজ!’
তো, মহাত্মার এই ভাবনা উৎকেন্দ্রিকতা ছাড়া আর কী!

যা হোক। লালন জীবনভর ‘মেটাফিজিক্যাল অ্যাংজাইটি’তে ভুগেছেন। লালনের বহু গানে তার প্রমাণ রয়েছে।
ইংরেজি Metaphysics শব্দের অর্থ ...philosophy of being: the branch of philosophy concerned with the study of the nature of being and beings, existence, time and space, and causality ...কাজেই ‘মেটাফিজিক্যাল অ্যাংজাইটিকে’ মহৎ বলেই গন্য করা যেতে পারে। কেননা, এ হল জ্ঞানতাত্ত্বিক বিষয় এবং জ্ঞানচর্চাকে প্রত্যেক জাতিই মহৎ বিষয় মনে করে।
লালনের অনেক গানে এই উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। যেমন-

ভেবে অন্ত নাহি দেখি
কার বা খাঁচায় কে-বা পাখি।

খাঁচা অর্থ ‘মানবদেহ’ এবং পাখি হল ‘চেতনা’। কাজেই এই আলোচনা বিস্তারিত হতে পারে এবং যা Metaphysical পর্যায়ের অর্ন্তভূক্ত। লক্ষনীয়, দুটি চরণে খানিক হলেও উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। তার কারণ- বাউলেরা বিশ্বাস করেন জগতের কর্তা বা শাঁই মানবদেহে বাস করেন। কিন্তু, কী তাঁর সরূপ? কী তাঁর উদ্দেশ্য? এসব বিষয়ে সঠিক উত্তর সহজে মেলে না। উদ্বেগ সে কারণেই।
লালনের অনেক গানে সত্ত্বা ও অস্তিত্ব সংক্রান্ত গোলমেলে প্রশ্নের আধিক্য রয়েছে।

কে কথা কয় রে দেখা দেয় না
নড়েচড়ে হাতের কাছে
খুঁজলে জনম-ভর মেলে না।
 


(আরেকটি বার Metaphysics শব্দের অর্থ স্মরণ করি ...philosophy of being: the branch of philosophy concerned with the study of the nature of being and beings, existence ...)
আসলে লালন ছিলেন দার্শনিক আর রবীন্দ্রনাথ কবি।
রবীন্দ্রনাথও এই মহৎ ব্যাধিতে ভুগেছেন । যে কারণে আর্তনাদ করেছেন তাঁর এক গানে -

কেন বাণী তব নাহি শুনি নাথ হে
অন্ধজনে নয়ন দিয়ে অন্ধকালে ফেলিলে।

(নাথ=আল্লাহ;গড। আর রবীন্দ্রনাথের এ দুটি চরণে ২৫০০ বছরের অধিবিদ্যার ইতিহাস নিহিত!)

অন্যত্র খানিকটা ক্ষোভের সুরেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে,
হে ছলনাময়ী ।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে ।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত ;
তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি ।

আমরা এও জানি যে-মধ্যযুগের চিকিৎসাবিজ্ঞানী আবু আলী ইবনে সিনা বুখারার জামে মসজিদে দীর্ঘক্ষণ সেজদায় পড়ে থাকতেন জগৎ ও আপন অস্তিত্ব বিষয়ক ধারণাগুলো স্বচ্ছ করার জন্য। তবে, সৃষ্টিকর্তা একনিষ্ট সত্যান্বেষীর কাছেও সহজে ধরা দেন না। যে কারণে জগতের মহৎ প্রাণেরা মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেন ...এবং সান্ত্বনার সহজ পথ খোঁজেন। যেমন লালন। লালনও উত্তর নিজেই খুঁজে নিয়েছিলেন । নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন এই বলে-

বহু তর্কে দিন বয়ে যায়
বিশ্বাসের ধন নিকটে পায়
সিরাজ শাঁই ডেকে বলে লালনকে
কুতর্কের দোকান খুলিস নে আর ...

কি আর করা। যুক্তিতর্কের পথ বন্ধ হোক। এসো বিশ্বাসের সুশীতল ছায়ায়। কুতর্কের দোকান খোলার কি দরকার? কে তুমি? এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসিলে উত্তর যেহেতু গুঞ্জরিয়া ওঠে না ...বরং এই ভালো। একটা কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছোন ...

ঐ একই গানে আছে

নিরাকারে জ্যোর্তিময় যে
আকার সাকার হইল সে

নিরাকার জ্যোর্তিময় হয় কি করে?
জীবনভর লালনের উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা এখানেই।
নিরাকার (shapeless ) কী ভাবে হয়ে ওঠে জ্যোর্তিময়? কি সেই ম্যাজিক? কী ভাবে আকারশূন্যতা থেকে উদ্ভব হয় আলোর? (এবং অনিবার্য ২য় প্রশ্ন-কীভাবে বস্তু থেকে উদ্ভব হয় প্রাণের ... যে আমি ধারণ করি প্রাণ? ) কিন্তু তার আগে এই প্রশ্নের সুরাহা হওয়া দরকার-নিরাকারে (formless) জ্যোর্তিময় (lighted) হয় কি করে? কি করে তা সম্ভব? সম্ভব যে হল তার সাক্ষী লালন, তার সাক্ষী আমরা। কিন্তু কেন সম্ভব হল? কি ছিল সৃষ্টির আদিতে? কী ভাবে সৃষ্টি সম্ভব হল? কেন হল? নিরাকারে জ্যোর্তিময় যে/আকার সাকার হইল সে ...এই পরস্পরবিরোধী ঘটনা ঘটল কোন অলৌকিক রসায়নে? সৃষ্টির পূর্বে চেতনা নিহিত ছিল কোথায়? কীভাবে? কেন তা বিকশিত হল? তার আগে এই প্রকান্ড বিশ্বব্রহ্মান্ড বিকশিত হল।

... যে খানে শাঁইর বারামখানা

এই মহাবিশ্বই কি শাঁইয়ের বারামখানা (বিশ্রামাগার?) ... মহাবিশ্বই কি শাঁই? নাকি মহাবিশ্বের সৃষ্টির চেতনা শাঁই? মানবদেহ কি শাঁই? না মানবদেহের অর্ন্তগত চেতনাটুকু শাঁই?
লালন জীবনভর মেটাফিজিক্যাল অ্যাংজাইটি তে ভুগেছেন।

আগে যদি যেত জানা
জংলা কভূ পোষ মানে;
তা হলে হায় প্রেম করতাম না
লালন ফকির কেঁদে কয় ...

লালনের এই জংলা পাখিই হল ‘চেতনা’। যে চেতনাকে দার্শনিক লালন জীবনভর বুঝেতে চেয়েছিলেন। পারেননি। আর পারেননি বলেই এই কান্না।
এবং এই বাউলশ্রেষ্ঠর কান্নাটি মহৎ।
লালনের এই মহত্তর ক্রন্দনের বিষয়টি বিশ্ববাসী এরই মধ্যে জেনে গেছে বলেই বিশ্বসভায় বাংলা এক অন্যতর মর্যাদা লাভ করেছে।
বিজ্ঞানীরাও মেটাফিজিক্যাল অ্যাংজাইটি তে ভোগে ।
তবে তাদের কেবল মেটাফিজিক্যাল অ্যাংজাইটি তে ভুগলেই চলে না, তাদের সৃষ্টিরহস্য সম্যক উপলব্দি করতে নানা উদ্যেগ নিতে হয় ,হাতে-নাতে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। এই কারণেই এই মুহূর্তে সুইজারল্যান্ডে আদিকণার খোঁজে চলছে বিজ্ঞানের ইতিহাসের সব চেয়ে ব্যয়বহুল বৈজ্ঞনিক পরীক্ষা। বিজ্ঞানীরা সৃষ্টিমুহূর্তে আদিকণার সরূপ জানতে চান। সেটি জানলেই নাকি মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি উন্মোচিত হবে।
দেখা যাক কি হয়।
তবে লালন উনিশ শতকে বেঁচে থেকে বিজ্ঞান নয় বরং নিজস্ব পন্থায় মহৎ উদ্বেগের গিট্টু খুলেছেন এভাবে-

দিব্যজ্ঞানী হয় তবে জানতে পায়
কলি যুগে হল মানুষ অবতার।

অর্থাৎ, যিনি জ্ঞানী, তিনি জানেন যে ইতিহাসের শেষ (কলি) যুগে মানুষেরই জয়জয়াকার। কারণ এ যুগে মানুষই অবতার। এবং এভাবে লালন বেশিক্ষণ ‘নিরাকারে জ্যোতিমর্য় যে/আকার সাকার হইল সে’-এই কঠিন প্রশ্নে রক্তাক্ত হননি। এই ধোঁয়াশা থেকে তিনি সরে এলেন কৌশলে। তিনি দার্শনিক কূটকৌশলের চেয়ে মানুষের ওপরই গুরুত্ব দিয়ে একটা রফা করলেন।
রবীন্দ্রনাথও একই পন্থায় সান্ত্বনা খুঁজেছেন।
জীবনের অন্তিমলগ্নে পৌঁছে লিখেছেন-

তোমার জ্যোতিষ্ক তারে
যে-পথ দেখায়
সে যে তার অনন্তের পথ,
সে যে চিরস্বচ্ছ,
সহজ বিশ্বাসে সে যে
করে তারে চিরসমুজ্জল।
বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু ,
এই নিয়ে তাহার গৌরব ।
লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত ।
সত্যেরে সে পায়
আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে ।

মহৎ উদ্বেগ বা Metaphysical anxiety  সহ্য করা অনেক কঠিন। নিয়ত যাদের ‘মহৎ উদ্বেগ’ সহ্য করতে হয় তারাই তা জানেন।
কাজেই লালনও রবীন্দ্রনাথের মতো এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন-

ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার ...

লালন আমৃত্যু ‘মহৎ উদ্বেগ’ ভোগ করেও মহৎ এক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, মানুষকে ঈশ্বরের (মানুষ গুরু) অনুসন্ধানে মগ্ন থাকতে বলেছেন । বলেছেন, তাহলেই মানবজীবনের সব সাধনা সার্থক।
এভাবে ‘মহৎ উদ্বেগের’ অবসান হয়েছিল কিনা তা লালনই জানেন।

 

ইমন জুবায়ের

প্রয়াত প্রাবন্ধিক, ব্লগার, গবেষক, গীতিকার।