লালন কী জাত সংসারে - ১ম কিস্তি

লালন কী জাত সংসারে - ১ম কিস্তি

২০০৮ এর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি হবে। জয়দেবপুর স্টেশন থেকে সুন্দরবন প্রভাতী ট্রেনে চড়ে কুষ্টিয়া জেলার পোড়াদহ স্টেশনে যাচ্ছিলাম। বাঞ্ছা ছিলো, সেখান থেকে বাসযোগে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলায় ছেঁউড়িয়াতে মহাত্মা লালন সাঁইয়ের আখড়ায় যাব। মহাত্মা লালন শাহ ১৮২৩ সালের দিকে এখানে আখড়া স্থাপন করেন। যতটুকু জানা যায়, তিনি সুফি সম্প্রদায়ভুক্ত মারফতি এবং বাউল মতের সমন্বয়ে ফকিরি ধারার বাউল মতে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়যুক্ত সাধনার বাণী প্রচারের ফলে বাউল-ফকির হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর মহাত্মা লালন শাহ ১১৬ বছর বয়সে সেখানে নিজ আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুরদিন রাত ৫টা পর্যন্ত তিনি গানবাজনা করেন এবং এক সময় তার শিষ্যদের কে বলেনঃ “আমি চলিলাম’’ এবং এর কিছু সময় পরই তার মৃত্যু হয়। তার নির্দেশ বা ইচ্ছা না থাকায় তার মৃত্যুর পর হিন্দু বা মুসলমান কোন ধরনের ধর্মীয় রীতিই নীতিই পালন করা হয় নি। তারই উপদেশ অনুসারে তার আখড়ার মধ্যে একটি ঘরের ভিতর তাকে কবর দেওয়া হয়। ইচ্ছা ছিলো সেখানে গিয়ে তাঁর ভক্তদের কাছ থেকে অকৃত্রিম সুরে দরদী কণ্ঠে কিছু গান শুনবো। তাঁর সহজ-সরল শব্দময় এই গানে মানবজীবনের রহস্য, মানবতা ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। মহাত্মা লালন সাঁইয়ের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যদিও ছিল না তথাপি তিনি সাধনাবলে এবং তাঁর গুরু সিরাজ সাঁইয়ের নিকট থেকে হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের শাস্ত্র সম্পর্কে উচ্চতর জ্ঞান লাভ করেন। তাঁর রচিত গানে এর পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর গান শুনলে মনটা যেন নিমিষেই এক আধ্যাত্মিক জগতে হারিয়ে যায়।

 

যাই হোক ট্রেনের কামরায় বসে আছি, এমন সময় এক অন্ধ বাউল ফকির একটা দোতারা হাতে মহাত্মা লালন সাঁইয়ের গান গাইতে গাইতে সামনে এসে দাঁড়ালেন। এই লাইনে ট্রেনে অনেক ফকিরই গান গেয়ে ভিক্ষা করে থাকে।
গানটি ছিল-
“ সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন বলে জাতের কী রূপ
দেখলাম না এই নজরে।।
কেউ মালায় কেউ তসবি গলায়,
তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায়।
যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়,
জাতের চিহ্ন রয় কার রে।। ”


তার গানের দরদী সুর আমার মনটাকে একদম আচ্ছন্ন করে ফেলল। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। আমি তার গানের ভাবে বিভোর হয়ে গেলাম। তিনি আবারও গাইলেনঃ


“জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা
সত্য কাজে কেউ নয় রাজী
সবই দেখি তানা না না...।”


এ গানটি শেষ করেই তিনি বললেন, “আমি অন্ধ মানুষ । সাঁইজীর বাণী নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। আপনাদের কারো আমার প্রতি একটু দয়া হলি আমাকে কিছু সাহায্য করতি পারেন। কারো পক্ষে সম্ভব হলি দেবেন আর না হলি না দেবেন। কুনো আপত্তি নি।”
দেখলাম, কয়েকজন তার দিকে সহানুভূতির হাত বাড়ালেন। তাতে দশ বিশ টাকা হবে হয়তো।
তিনি আবার বললেন, “বাবারা, আমি অন্ধ হলেও জন্মান্ধ ছিলাম না। এই গান শিখতে যাওয়ার কারণে আমাকে গ্রামের লোকজন জোর করে অন্ধ করে দিয়েছিল। পরে যতটুক শিখেছি তা কেবল সাঁইজীর এই বাণী। আমি তো আর কর্ম করে খাতি পারি না। তাই আপনাদের কাছে হাত বাড়াতি হচ্ছে। আজ আপনারা যতটুকু সাহায্য দিয়েছেন আমি তার জন্য মালিকের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।”
লোকটাকে আমার খুব পছন্দ হলো। পরণে সাদা লুঙ্গি। গায়ে একটি সাদা চাদর। কাঁধে অনেক পুরাতন একটা ঝোলা। বয়স পঞ্চাশের উপরে তো হবেই। মাথার চুল, দাড়ি-মোছ সব পেকে গেছে। আমি তাকে ধরে আমার পাশের খালি আসনে বসালাম। অনুরোধ করলাম, “বাবাজী, আরো একটি গান শোনালে হয় না গো?”
তিনি আমার অনুরোধ রাখলেন।
গুরু-রূপের পুলক ঝলক দিচ্ছে যার অন্তরে/কিসের আবার ভজন সাধন লোক জানিত করে/বকের করণ ধরণ তাইরে হয়/দিক ছাড়া তার নিরিখ ও সদায়/ওসে পলক ভরে ভবপারে/যায় সে নিরিখ ধরে।/গুরুভক্তির তূল্য দিব কি?/যে ভক্তিতে থাকে সাঁই রাজী/অধীন লালন বলে গুরুরূপে/নিরিখ মানুষ ফেরে।/জ্যান্তে গুরু পেলেম না হেথা/ম’লে পাবো কথারই কথা/অধীন লালন বলে গুরুরূপে/নিরূপ মানুষ ফেরে।


গানটি শেষ হতেই আমি আবারো অনুরোধ করলাম। বাবাজী বড্ড ভালো লাগছে গো। তৃষ্ণা যে বেড়েই চলেছে। আরো একটা যদি... আমার কণ্ঠ শুনে তিনি তার হাতটা আমার মুখে বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “বাবা, আপনি সাঁইজীর গান শুনে কাঁদছেন? আর আমি গান না শোনালে কি চলবি।”
তিনি গাইলেন…
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে/আমার বাড়ির কাছে আরসীনগর,/এক পড়শী বসত করে। গেরাম বেড়ে অগাধ পানি,/ তার নাই কেনারা নাই তরণী পারে/মনে বাঞ্ছা করি, দেখব তারে, আমি কেমনে সেথা যাইরে। আমি বলক কি পরশীর কথা/তার হস্ত-পদ-স্কন্ধ-মাথা নাইরে/ সে ক্ষণেক ভাসে শূন্যের উপর/সে ক্ষণেক ভাসে নীরে। সে পড়শী যদি আমায় ছুঁতো/তবে যম যাতনা সকল যেত দূরে/ সে আর লালন একখানে রয়/থাকে লক্ষ যোজন ফাঁকরে।

তিনি গানটি পুরো শেষ করতে পারলেন না। যেন তার অন্ধ চোখ দিয়েও অশ্রু বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। কত ভক্তি দিয়ে তিনি গাইলেন। আমিও আর নিজের আবেগটাকে সামলাতে পারলাম না। একা একা ভ্রমণ করার এই এক মজা। লোকের ভিতরে থেকেও লোক লজ্জা থাকে না।
তিনি বললেন, “বাবা, এবার তবে আমি আসি গো। সামনের স্টেশনে নাবতি হবি। বললাম, আরো একটি কথা আছে। আপনি প্রথমেই শুনিয়েছিলেন, “সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।”
বাবারে সকলেই এই একই প্রশ্ন করে। আর তিনি নিজেকে ফকির হিসেবে পরিচয় দিয়ে গেছেন। ফকিরের আবার জাতের দরকার আছে নাকি? এই যে, আমি একজন ফকির। গান গেয়ে ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছি। ঘরে শেয়ানা মেয়ে আছে। তার বিয়ে দিতি হবি। কিন্তু কি করব। দেখেন- এই জাতির পরিচয়ের জন্য মেয়েটারও বিযে-থা দিতি পারছি নি। সে যে একজন নারী। সে যে মায়ের জাতি এটা কি তার পরিচয়ের জন্য যথেষ্ঠ না গো বাবা? কিন্তু না। সমাজ আমাকেও একটা জাত দিয়ে দিয়েছে। এই যে আমার দুটো চোখ নেই। সমাজ আমাকে নেড়ে ফকির বলে গালি দিয়ে জোর করে যেদিন চোখ দুটো উপড়ে নিলো, সেদিন মালিকের কতো দোহায় দিলাম। তারা তা শুনলো না। কী করব বাবা। সবই মালিকের ইচ্ছা। আমি তো মুসলমানের ঘরেই জন্ম নিয়েছিলাম। তবে তারা আমার চোখ দুটো উপড়িয়ে নিলো কেন? ঐ চোখ কী কাজে লাগবে তাদের? বাবারে জাত ধর্ম কোন কথা না। আত্মার ধর্মই ধর্ম।মানুষ হতি না পারলি জাত দিয়ে কি করবেন? বাবাজী, আপনাকে বলা যায়। আপনি বুঝলেও বুঝতে পারবেন। না বুঝলে বোঝানো কার সাধ্যি। বলেন তো, আমরা যাকে আল্লাহ বা ভগবান- ঈশ্বর যাই বলি- তার কি কোন জাত আছে? না কি তার কোন রূপ আছে? তার কোন জাতও নেই। তার কোন রূপও নেই। তিনি পাক। তাহলে তার সৃষ্টির কেন জাত থাকতি যাবি? আমরা মানুষ জাতি এইটাই কি বড় পরিচয় না? বাবা, দয়াল নবীকে পাক কিতাবে আল্লাহ সকল মাখলুকের জন্য রহমত স্বরূপ বলেছেন। তা হলি তাকে মৌলভীরা শুধু মুসলমানের নবী বানিয়ে রেখেছেন কেন? তিনিই তো তামাম মাখলুকের ছায়া। তাই না? আপনারা জ্ঞানী-গুণী মানুষ। আপনাদের বোঝানো আমাদের সাজে না। চরম অস্তিত্ত্ব ও পরম তত্ত্বের সন্ধানী লালন সাঁইজী ঐশি জ্ঞানের দিব্য জ্ঞানী ছিলেন গো বাবা। তার জাত পরিচয় কী আর দেব। তবে বাবা, ইশারায় একখান কথা কয়ি ‍যাচ্ছি- কোন নদী যখন সাগরে গিয়ে মেশে তখন সেও তো সাগর হয়ি যায়, না কি? ধর্মে কি ফানাফিল্লাহ, বাঁকা বিল্লাহ এসব নি? আছে। মৌলবীরা হাদিসে কুদসীর বরাত দিয়ে এ কথা কয়। কিন্তু তারা নিজেরা কতটুকু বিশ্বাস করে তা জানিনে গো বাবা। তবে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা গুরুবাদী মানুষ। গুরুই আমাদের সব। এই টুকুই তফাত গো বাবা। এখানে আর কোন কথা বলা যাবিনিনে। আমি যাই গো বাবা।”


তার জ্ঞানের বহর দেখে আমি আরো অবাক হয়ে গেলাম। কি সুন্দর মিষ্টি মিষ্টি কথা। কত নম্র, অমায়িক আর ভদ্রলোক সে। তাঁর কথা শুনে মন জান জুড়িয়ে গেল। আহ! তার কথাগুলো যদি আমি হুবহু শোনাতে পারতাম! আমি আজ তাঁর ভিতরে সাঁইজীর ছায়া দেখতে পেলাম। যেন স্বয়ং সাঁইজী এসে আমার হৃদয়টাকে ছুঁয়ে দিয়ে গেল। অবশেষে আমি তার হাতে সামান্য কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বললাম- বাবাজী, আপনার কথা শুনে আমার মনেও ভাব এসেছে। আমিও দুটো লাইন মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি। যদি অনুমতি দেন তবে আপনাকে শোনাতে পারি?
তিনি তা না শুনেই বললেন, “বাবাজী, আপনি সাঁইজীর আখড়ায় যাচ্ছেন, যান। তবে আপনারা যারা মনে করেন যে, আখড়ার ফকিররা সব গাঁজাখোর তারা হয়তো ফকিরদের সম্পর্কে ভালো করে জানেন না। অনেকেই না বুঝে বিড়ি সিগারেটের মতো গাঁজা খেয়ে থাকে। সাঁইজী তো গাঁজা সেবন করেন নি। তার কোন দরকারও নেই। এটা এই ত্বরীকে নেই বাবা। আর ভক্তি ভালবাসা থেকে যে বাক্য তৈরী হয় তা তো ভালোই হবি। আপনার রচিত পদও খুব ভালো হইছে বাবা। আপনাকে আশির্বাদ করছি বাবা।”


তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং সামনের স্টেশনে নেমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন। আমি যে সাঁইজীর আখড়ায় যাচ্ছি এ কথা তো তাকে একবারও বলি নি। আমি মনে মনে ভেবেছিলাম যে, বাউল ফকিররা হয়তো গাঁজা খেয়ে থাকে কিন্তু সে কথাও তো তাকে আমি বলি নি। তবে কেন সে আমার মনের কথাগুলোর উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল? আর সে জানলোই বা কী করে?
আমি আরো অবাক হলাম, যখন যাওয়ার পথে দোতারায় টুকা দিয়ে গাইতে শুরু করলেন-
সাগর নদী মিশে গেলে হবে একাকার
কে নদী কে সাগর বলবে কে এবার।
নদী ছোটে সাগর আশায়
নদীর পানে সাগর তাকায়
এমন ভাবের খেলায় কে বলো কার?
মহা জাতে মিশলে হৃদয়
আমিত্বটা হবেই বিলয়
ভাবের তথায় হচ্ছে উদয়, সকলই যে তার।

আরে কী অসম্ভব ব্যাপার। এই লাইনগুলো তো আমি এইমাত্র কাগছে লেখলাম। আমি তো কারো বাক্য নকল করি নি। তাকে শোনাইও নি। তবে সে এই পদ নিয়ে গাচ্ছে কীভাবে? দেখলাম- তিনি শেষের লাইনটিও গাইলেন- সাহিদে ভাবছে বসে/ দেহ-মন গেলে খসে/ ভাব হবে না বসে বসে, সামনে অন্ধকার।
আমি তার দিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু ততক্ষনে ট্রেন ঈশ্বরদী স্টেশনে থামতেই তিনি খুব দ্রুত ট্রেন থেকে নেমে যেন আমার কাছ থেকে পালাতে চাচ্ছিলেন। আমি ডাকলাম কিন্তু তিনি আর সাড়া দিলেন না।        [চলবে]

 

 

লালন কী জাত সংসারে - ২য় কিস্তি

শাহিদুল হক

কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক।