লালন কী জাত সংসারে - ২য় কিস্তি

লালন কী জাত সংসারে - ২য় কিস্তি

ঈশ্বরদী স্টেশন থেকে ভেড়ামারা পর্যন্ত আমি একটি ঘোরের মধ্য দিয়ে পার করেছি। ভেড়ামারা স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়তেই আমার সামনের আসনে বসা একজন বয়স্ক মহিলা আমাকে ডেকে বললেন, বাবা, আমার কথা শুনছেন?
আমাকে বলছেন?
জ্বি বাবা, আপনাকেই বলছি।
বলুন।
আপনি আজ আর আখড়ায় যেয়ে কি করবেন। আজ না হয় না গেলেন। আপনার মনের অবস্থা খুব ভালো ঠেকছে না।
আপনাকে তো ঠিক…
“আমার বাড়ি যশোরে। আমি জয়দেবপুর স্টেশন থেকেই ট্রেনে উঠিছি। আমার ছোট ছেলে জয়দেবপুর এক গার্মেন্সে চাকরি করে। ছেলের কাছে বেড়াতে গিয়েছিলাম। বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি। আমার বড় ছেলেও লালন ত্বরিকে। সে গ্রামে থেকে খেত-খামার দেখা-শোনা করে আর রাতে সাঁইজীর গানের মধ্যে ডুবে থাকে। সে অনেক ভারী ভারী কতা কই। তার কথা কিছু বুঝি, কিছু বুঝি না। আমি তার মা- তাই তার দিলের খবর কিছুটা আঁচ করতে পারি। তা ছাড়া ছেলের সাথে থাকতি থাকতি অনেক কিছু এই লাইনের জানা হোইছে। সাঁইজীর প্রতি আপনার দরদ দেখে কথাগুলো কলাম। আচ্ছা বাবা কন তো, লালন সাঁইয়ের কি কোন ছবি আছে?” মহিলা প্রশ্ন করলেন।
বললাম, না। তাঁর সঠিক কোন ছবি নেই। অনুমানে আঁকা ছবি অবশ্য আছে।
“তাইলে তাঁর ছবি ছুরত যদি না থাকে আর আপনি তাকে কোন দিন না দেখেন তাহলে সাঁইজীকে দেকলি আপনি চেনবেন কেমন করে?”
সাঁইজীকে দেখলে চিনবো মানে? তিনি তো মারা গেছেন! দেখার প্রশ্ন আসলো কেমন করে? বললাম তাকে।
“এই হলো সমস্যা। আপনার কাছে যে বসে থেকে গান কয়ে গেল তবে সে কিডা? তারে কি আপনি চেনেন? ” মহিলা প্রশ্ন করল।
“না তো! চিনি না।” তাকে বললাম।
““বাবারে- যে লোকটা আপনার দিলের সাথে দিল মিশিয়ে দিলের খবর কয়ে গেল তাকেই আপনি চিনতে পারলেন না? তাই বলছি, আজ আর আখড়ায় যেয়ে কোন কাজ নেই। বাড়ি যাইয়ে কিছু ভাবনা চিন্তা করেন। পরে মনটা থির হলি যাবেন। আজ তো মিলন হলোই। শোনেনঃ


“মানুষে মানুষের বিহার
মানুষ হলে দৃষ্ট হয় তার
সে কি বেড়ায় দেশ-দেশান্তর
পিঁড়েয় বসে পেঁড়োর খবর পায়।”


“আমার কতাই কি কষ্ট পাইলেন বাবা? আমারে ক্ষমা করে দিয়েন। আমিও মুখ্য সুখ্য মানুষ। আপনার হাল অবস্থা দেখে আর চুপ করে থাকতি পারলাম না। তাই কয়ডা কথা কলাম। জীবনে তো আর দেখা নাও হতি পারে। আজ আয়নার মধ্যি যখন তার ঝলক দেখলাম তকন আয়নার সাথে দুটো কতা না কলে যে মনটাকে পরে বুঝাতি পারব না। বাবা- হযরত আলী(রা) বলেছেন, “হে হোসাইন, তুমি কি মনে কর যে, তুমি অতি সামান্য একটি আকৃতি বিশেষ। তোমার মধ্যে বিশাল ব্রহ্মাণ্ড নিহিত এবং তুমি প্রকাশ্য কিতাব বিশেষ যার বর্ণমালার দ্বারা তোমার অন্তর্নিহিত রহস্যসমূহ উদঘাটিত হচ্ছে। এতএব, বাইরে তোমার দৃষ্টি দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। তোমার মধ্যে সারিবদ্ধ যে বর্ণমালা রয়েছে, তাই তোমার অনন্ত রহস্য প্রকাশ করছে।”
মহিলা তার মতো করে কথাগুলো আমাকে বললেন। কিন্তু আমি তার আয়নার উপমা শুনে চমকে উঠলাম। আয়নার মধ্যে ঝলক?
তখন সে বলল, “আপনার দিলের পেরেশানী আপনি বুঝতি পারছেন না? আপনার দিলে তার ভাবের উদয় না হলি আপনি এমন পেরেশান হবেন কেন?”
আজ আমি মহা ফেরে পড়ে গেছি। সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারছি না। এও তো দেখছি সামান্য মহিলা না।
লালন সংগীতে নারীর ভূমিকা সম্পর্কে বহু তত্ত্বকথা বিভিন্ন রূপকের মোড়কে ব্যক্ত হয়েছে। নারী ও পুরুষের পার্থক্য গভীরভাবে বর্ণিত হয়েছে। নারীর স্বভাব, রকম ও পদ্ধতির সংগে পুরুষের কর্ম ও ধর্ম পৃথক। তবে একে অপরের পরিপূরক শক্তি হিসেবে বিশ্ব প্রকৃতিতে চিহ্নিত হয়েছে। লালন সংগীতে ‘ত্রিবেণী’ শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। এই ত্রিবেণীর অধিকারী নারী। নারীর তিন স্থানের বা অবস্থানের সংগে গুপ্তভেদের ইঙ্গিতের ধারক ও বাহক এই শব্দটি। এটি এই ত্বরিকের ভজন-সাধনের উপায় অবলম্বনের বিষয়রূপে চিহ্নিত। লালন ত্বরীকার সাথে জড়িত নারীদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্পর্কে আমি সেই যৌবনের প্রারম্ভ থেকেই কিছুটা আঁচ করতে পারি। সুযোগ হলে সে কথা আরেক দিন শোনাতে চেষ্টা করব। আমার কাছে মনে হলো এই মহিলাও একজন অসামান্য জ্ঞানের অধিকারিনী। যদিও তিনি বলছেন তিনি এই সাধনার সাথে যুক্ত না। অস্তিত্বের রহস্যের কর্ম ও ধর্ম পদ্ধতির ওপর সার্বক্ষণিক দৃষ্টি না রাখলে আত্মদর্শন হয় না। আর আত্মদর্শন ছাড়া সত্তার আদি রহস্য সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়াও সম্ভব না। আমি তো আত্মতত্ত্ব জানি না। কিন্তু মহিলা আমাকে বললেনঃ


“আত্মতত্ত্ব যে জেনেছে
দিব্যজ্ঞানী সেই হয়েছে
কুবৃক্ষে সুফল পেয়েছে
আমার মনের ঘোর গেল না।।
যে ধনের উৎপত্তি প্রাণ ধন
সে ধনের হলো না যতন
অকর্মের ফল পাকায় লালন
দেখে শুনে তার জ্ঞান হলো না।।”


“সাঁইজীর এই গানটা আমার ছেলে প্রায় রাতেই গায়। আমি ঘর গেরস্তী করি। এই সব ভেদের কথা কিইবা বুঝি। আপনিও আমার ছেলের মতোই। আপনার দিলেও সাঁইজীর প্রতি মহব্বত আছে। তাই দুটো কতা কয়ে সময় কাটালাম। আপনি তো সামনের ইস্টিশনেই নেমে যাবেন?”

         সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামী আর অজ্ঞানতার মূল কারণ হলো নিজেকে না চিনা কিংবা বিষয়কে গভীরভাবে না জানা। আমাদের সমাজের এই হানাহানির মূলে আছে অজ্ঞানতার মাঝে বন্দী থাকার কারণ। যে জন্য বর্তমান সমাজে নামাজীরা ভ্রাতৃত্ববোধ থেকে দূরে সরে গিয়ে কেউ জামাতী, কেউ তাবলিগ জামাতী, কেউ শিয়া, কেউ সুন্নি, কেউ ওয়াহাবীসহ হাজারো সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে মসজিদে মসজিদে তাণ্ডবলীলা চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ আবার মসজিদকে বাসাবাড়ি বানিয়ে ফেলেছে। তারা এক কাতারে নামাজ পড়েও এক হতে পারছে না। এসব দেখে বুকের রক্তক্ষরণ বেড়েই চলেছে। কেউ শান্তি পাচ্ছে না নামাজ পড়েও। তাই কিছুক্ষণের জন্য তাপিত হৃদয়কে জোড়ানোর জন্য সব কিছুর বাইরে গিয়ে দু’দণ্ড সময় কাটাতে ঘর থেকে বের হয়েছি। সামনেই পোড়াদহ স্টেশন- কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাব। ভদ্র মহিলাকে বললাম, “মাগো- আপনি আমার ভক্তি নিন। আমি সত্যিই কিছু বুঝি না। আপনি ঐ অন্ধ বাউল-ফকিরের মধ্যে সাঁইজীকে দেখে তাকে ভক্তি দিলেন। আর আমি তাকে পাশে বসিয়েও যথাযথ গুরুত্ব দিতে পারলাম না। সত্যিই তো আখড়ায় গিয়ে হাজারো ভক্তের মাঝে সাঁইজীকে আমি একাকী কেমন করে পাব।”
মহিলা বললেন- সাঁইজীর গানে আছে, “শাঁইর লীলা বুঝবি ক্ষেপো কেমন করে/লীলার যার নাইরে সীমা/কোন ছলে কোন রূপ ধরে।।”
বিশ্বাসের ধন নিকটে পেতে হলে “ নিরাকারে জ্যোতির্ময় যে” এই কথার ভেদ বুঝতি হবে। মানুষ দেহ নিয়ে জগতে আসে আবার ফিরে যাবে আরেক জগতে। সেই জগতের আকার গ্রহণের জন্য মানুষের মনই এই জগতে বীজ তৈরী করে। তাই মনের সুস্থ অবস্থা অর্জন করতি পারলি বিশ্বাসের ধন নিকটে পাওয়া যায়। কুতর্ক করে সমাজে গোল বাধানো যায়।তাতে মনের মুক্তি মেলে না। মানব গুরু ছাড়া এই ধন পাওয়া যাবে না। মানবগুরু আয়ত্বে থাকলে “সর্ব-সাধন সিদ্ধ হয় তার”। শুধু বিশ্বাস করলি কাজ হবে না। উপলব্ধি করতি হবে। বিশ্বাসেরও ভেদ আছে। তা গুরু ধরে জানতি হবে। জানতি পারলে মনের মানুষের সাথে মিলন হবে। আল্লাহর সকল শক্তি নবী ও আদমে প্রকাশ ও প্রচার হয়েছে। বুঝতি হবে। ঠিক আছে বাবা। আপনি আপনার স্টেশনে পৌঁছে গেছেন। এখন নেমে যান। আজ আর আখড়ায় যাবেন না। মন শান্ত হলি যাবেন। তবে আমার জন্য মালিকের কাছে দোয়া করবেন। আমিও দোয়া করব।”
আমি মহিলার দিকে শিক্ত চোখে বার কয়েক তাকিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। আমি যেন তখন শূন্যে ভাসমান। কোথায় যাচ্ছি কেন যাচ্ছি কিছুই বুঝতে পারছি না। স্টেশনের বিশ্রামাগারের দিকে পা বাড়ালাম। এমন সময় শুনতে পেলাম স্টেশনের এক পাশে দাঁড়িয়ে এক বাউল ফকির গাচ্ছে-


“আমার মনের মানুষের সনে
মিলন হবে কতদিনে।
চাকত প্রায় অহর্নিশি
চেয়ে আছি কালো শশী
হব বলে চরণ দাসী;
তা হয় না কপাল গুণে।।
মেঘের বিদ্যুৎ মেঘে যেমন
লুকালে না পায় অন্বেষণ
কালারে হারালে তেমন
ও রূপ হেরিয়ে দর্পনে।।
যখন ঐ রূপ স্বরণ হয়
থাকে না লোক-লজ্জার ভয়;
অধীন লালন বলে সদায়
প্রেম যে করে সেই জানে।।”

 

         পোড়াদহ জংশন। এটা কুষ্টিয়া জেলার সদর উপজেলার একটা নামকরা জংশন। এখান থেকে ট্রেনে কুষ্টিয়া যাওয়ার খুব ভালো ব্যবস্থা আছে। কুষ্টিয়া জেলা সদরে দুটো স্টেশন। প্রথমে কুষ্টিয়া কোর্ট স্টেশন। এর পরেই গড়াই নদীর ধার ঘেষে কুষ্টিয়া বড় স্টেশন। ছেঁউড়িয়াতে যেতে হলে এই স্টেশনেই নামতে হবে। এখান থেকে রিক্সা বা স্থানীয় যানবাহনে যেতে পনের বিশ মিনিটের মতো সময় লাগতে পারে। আমি ছেঁউড়িয়ার কাছাকাছি হরিশংকরপুর গ্রামে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটাব বলে মনস্থ করে তাকে আমার ইচ্ছার কথাটি মোবাইলে জানালাম। সে এ সংবাদে খুব আগ্রহ দেখাল। আমি ট্রেনের অপেক্ষায় বসে না থেকে প্রথমে বাসযোগে চৌড়হাঁস গেলাম। সেখান থেকে রিক্সাযোগে তাদের বাসাতে গিয়ে পৌঁছলাম। সিদ্ধান্ত পরের দিন সকালে ছেঁউড়িয়ায় যাব।
পোড়াদহ থেকে এক ঘণ্টার মধ্যেই আমি সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম। তাদের আন্তরিক অভ্যর্থনায় আমি যারপরনায় মুগ্ধ। এখানে একটা কথা বলি রাখি। আমার বন্ধুরা জমক দুই ভাই। দু’জনকে দেখতে ঠিক একই রকম। আমি তার বড় ভাইকে(এক মিনিটের বড়) দেখতে পেয়েই আমার বন্ধু ভেবে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করলাম। সেও খুব আনন্দ করল। পরে বলল- ও বাসায় রয়েছে। আমি ওর বড় ভাই। আমিও হেসে দিয়ে বললাম এটাই হলো আনন্দের ভুল।
বিকালে চা-পর্বে তার মিসেসকে রসিকতা করে জিজ্ঞাসা করলাম, ভাবী আপনার কোন ভুলটুল হয় না তো। সে লজ্জামাখা হাসি দিয়ে বললো- তা প্রথম প্রথম বেশ হতো। এখন আর হয় না। জানলাম বড় ভাইয়ের সামনের পার্টির উপরের একটা দাঁতের কোণা ভাঙ্গা। এ ছাড়া তার চোখের ডান ভ্রুতে কাটা দাগ আছে। আর তেমন কোন পার্থক্য না থাকলেও পরিচিতদের চিনতে কোন অসুবিধা হয় না।
যাইহোক- আমার বন্ধুর সাথে চা-পর্ব শেষ করে আমার উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা সম্পর্কে তাকে বিস্তারিত বললাম। সে সাথে থাকতে আগ্রহ দেখাল। তাকে জানালাম আজ রাতে তাদের বাড়ির উঠানে একটা গানের আসর বসালে কেমন হয়। এতে সে বিনয়ের সাথে অপারগতা প্রকাশ করল। আরো জানালো যে, তাদের গ্রামের লোকজন বাউলদের ভালো চোখে দেখে না। বে-শরা ফকির হিসেবে গণ্য করে। তাদেরকে মুসলমান হিসেবেও স্বীকৃতি দেয় না। যাইহোক আমি সে প্রসঙ্গে যেতে চাচ্ছি না। আমার বন্ধু আমার আগ্রহের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাদের স্কুল মাঠে একজন বাউলকে দিয়ে গান গাওয়ানোর আয়োজন করল। তার সাথে আরো চার/পাঁচজন ছিল। তাদের এ বিষয়ে যথেষ্ঠ আগ্রহ দেখলাম। আর আমার বন্ধু তাদের মাধ্যমেই এই আয়োজনটা সম্পন্ন করল।
রাতের খাওয়াটা রাত ন’টার মধ্যেই শেষ করে আমরা সেখানে রাত ১০টায় গিয়ে হাজির হলাম। চাঁদের রাত। খুব সুন্দর পরিবেশ। দু’টো পাটি বিছিয়ে আমরা মুক্ত আকাশের নিচে সবাই বসে গেলাম। আসরের গায়কের বয়স চল্লিশের উপরেই হবে। তবে খুব স্থির চিত্তের মানুষ বলে মনে হলো। পরিচয় পর্ব শেষ করে সে দোতারায় টুকা দিল-


“কবে সাধুর চরণধূলি মোর লাগবে গায়।
বসে আছি আশা-সিন্ধুর তীরে সদায়।
ভজন সাধন আমাতে নাই
কেবল মহত নামের দেই গো দোহাই
নামের মহিমা জানাও গো সাঁই
পাপীর হও সদায়।।
চাতক যেমন মেঘের জল বিনে
অহর্নিশি চেয়ে আছে মেঘ ধিয়ানে
তৃষ্ণায় মৃত্যু গতি হয় জীবনে
সেই দশা হলো আমায়।।
শুনেছি সাধুর করুণা
সাধুর চরণ পরশিলে হয় গো সোনা
আমার ভাগ্যে তা হলো না
ফকির লালন কেঁদে কয়।।”

তার কণ্ঠে প্রথম গান শুনেই আমরা সবাই মুগ্ধ। অসাধরন কণ্ঠে সে যেন সুরের ইন্দ্রজাল বিছিয়ে দিল। আমি ভাবের গভীরে তলিয়ে গেলাম। প্রথম ধাক্কাতেই লক্ষ্য করলাম আমার চোখে অশ্রু চলে এসেছে। সাথীরা সবাই চুপচাপ। লালন সাঁইয়ের আত্মদর্শনের সংগীতগুলোই সাধকের সাধনার দিকদর্শন হিসেবে প্রকাশিত। বাউল দর্শনের মতবাদ ও কেন্দ্র হলো গুরু বা সাধু। সাধুর দয়া ব্যতীত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না। সাধুর দেওয়া বিধান এবং আত্মতত্ত্বের আত্মবাণীই প্রকৃতপক্ষে সংগীতের উপকরণের মৌলিকক বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে। গুরু-শিষ্যের প্রেম, ভজন-সাধন, ভক্তি, চর্চা ও অনুশীলনের বিষয়টি এ গান থেকে অনুধাবন করা সম্ভব। গুরুর প্রতি শিষ্য যদি চাতকের মতো ভরসা করে থাকতে পারে তবে ভজন সাধন না হলেও সে পার পেয়ে যাবে। কারণ সাধুর সুনজর যে শিষ্যের উপর পড়বে সে যতবড় পাপিই হোক না কেন খাঁটি সোনা হয়ে যাবে। এই গানে শিষ্যকে সাধুর প্রতি একনিষ্ঠ হয়ে চাতকের মতো ধৈর্য ধারণের মন্ত্র শিখানো হয়েছে। মূলত এই গানে ভজন-সাধনের উর্ধ্বে ভক্তি ও ভরসাকে স্থান দেওয়া হয়েছে যা মুক্তির প্রেরণা হিসেবে যথাযথভাবে প্রস্ফুটিত।
গায়ক- আমাদের মনের ভাব বুঝতে পেরে আমার শুরু করলেন-

“ডাকরে মন আমার হক নাম আল্লা বলে
মনে ভেবে বুঝে দেখ, সকলি না হক
হক মোর আল্লার নাম তাও ভুলিলে।।
ভরসা নাই এ জেন্দেগানী
যেমন পদ্ম পাতার পানি
কোনদিন পড়িবে টলে
সুখের বাড়িঘর
কোথায় রবে কার
হক না হক তাই কেবল সঙ্গে চলে।।
ভবের ভাই বন্ধু যারা
বিপদ দেখিলে তারা
পালাবে ফেলে।।
কার ধনেতে ভাই
আখেরে পাই রেহাই
তাই ভাব মন দেলে দেলে।।
অকালে দিন হলো রে শাম
কবে নিবা সেই আল্লার নাম
ভবের বাজার ভাঙ্গিলে।।
(এবার) পেয়েছ রে মন দুর্লভ জনম
লালন বলে এ জনম যায় বিফলে।।”

মহাত্মা লালন সাঁই এই গানে আল্লাহর মৌলিকত্বের বিষয়টি যেমন ফুটিয়ে তুলেছেন ঠিক তেমনই কেবল আল্লাহর উপর ভরসাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। এখানে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে লালন বলছেন একমাত্র আল্লাহই হক আর সব না-হক। তাই এই নাম ভুলে গেলে জীবনের সব কর্ম না-হক বা বাতিল হয়ে যাবে। ভবের বাজার ভেঙ্গে গেলে তখন এই নাম নিয়ে আর কোন কাজে আসবে না। তাই কারো উপর ভরসা না করে এই নামকেই বুকে ধারণ করতে হবে। এই উদাত্ব আহ্বান অনেক গভীরের বিষয়। কিন্তু সাধারণের বোধগম্য বটে।তবে লালন ত্বরীকে গুরুর গুরুত্ব শিষ্যের কাছে শীর্ষে থাকার বিষয়টি বুঝতে হলে স্রষ্টা ও সৃষ্টির ব্যাখ্যা বুঝতে হবে। লালন মানবদেহের মধ্যেই দিব্যজ্ঞানে আত্মদর্শনের মাধ্যমে স্রষ্টার সন্ধান করার আহ্বান করেছেন। সাঁইজী এক গানে বলেছেন, “ কিরূপ সাধনের বলে অধর ধরা যায়/নিগূড় সন্ধান জেনে শুনে সাধন করতে হয়।” আমি মনে করি জন্ম, বীজ ও জন্মলতা সংস্কারে বন্দী হলে যেমন আমিত্ব ও অজ্ঞানে আটকে পড়তে হয় তেমন এ সব কিছুকে বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর দিকে যাত্রার যে বাসনা তা উপলব্ধি করতে পারলে মানুষে মানুষ রূপের লীলা বোঝা সম্ভব হয়। যারা ভিন্ন ত্বরিকায় সাধন করে অলি-আউলিয়া হয়েছেন তারাও তাদের মোর্শেদকেই গন্তব্যের লক্ষ্য বানিয়ে নিয়েছেন। ভিন্নতা হলো- তাঁরা শরিয়তের নির্দেশিত পথে থেকেছেন আর লালন সাঁই কোরআনের আধ্যাত্মিক রহস্যকে হৃদঙ্গম করে তার ভিতর ডুবে গেছেন। বলতে গেলে তিনি বিষয়বস্তু শূন্য করে পরমতত্ত্বের অনুসন্ধানী হয়েছেন। তিনি অসংখ্য গানে দায়েমী নামাজ, রোজা, রোজ কেয়ামত, ইল্লীন-সিজ্জীন, পুলসেরাত, পাপ, পুণ্য, মেরাজ, আবেহায়াত, নবী,রাসুল ও আল-কোরআন সম্পর্কে প্রচুর গান রচনা করেছেন। তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে যে প্রত্যেকটি গানই যেন এক একটা মহা-সমুদ্র। মূল কথা লালন সাঁইয়ের গানে মানব অস্তিত্বই মহান আল্লাহর আদি ও অনন্ত লীলাতে প্রকাশ। সৃষ্টির মধ্যেই স্রষ্টার আদি রহস্য। তাই মানুষনিধি ছাড়া মুক্তির উপায় নেই। তাই তিনি বাহ্যিক উপাসনাকে এড়িয়ে চলেছেন।
আমরা এবার একটু বিরতী দিয়ে চা-পান করলাম। লক্ষ্য করলাম আমাদের গায়ক ভাবের তুঙ্গে অবস্থান করছেন- তার ভিতর ভাব চলে এসেছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু লোক এসে জড় হয়েছে। তারাও চুপচাপ গান শুনতে বসে গেছে। আমাদের সাথীরাও গানের দিকে ঝুকে পড়েছে। তিনি এবার গাইলেন-

“মানুষ তত্ত্ব যার সত্য হয় মনে
সে কি অন্য তত্ত্ব মাণে‘।।
মাটির ঢিবি, কাঠের ছবি
ভূত ভাবে সব দেবাদেবী
ভোলে না সে এসব ছবি
ও যে মানুষ রতন চেনে।।
জিন-ফেরেস্তার খেলা
পেঁচাপেঁচি আলাভোলা
তার নয়ন হয় না ভোলা
(ও সে) মানুষ ভজে দিব্যজ্ঞানে।।
ফেও ফেঁপি ফেকসা যারা
ভাঁকা-ভূকোয় ভোলে তারা
লালন তেমনি চটা মারা
ও ঠিক দাঁড়ায় না একখানে।।”

তিনি এ গানটি শেষ করেই আবার পরের গানে সুর তুললেন-

“ওরে আলেকের মানুস আলেকে রয়
শুদ্ধ প্রেম-রসিক বিনে কে তারে পায়।।
রস-রতি অনুসারে
নিগুঢ় ভেদ জানতে পারে
মতিমে রতি ঝরে
মূল খণ্ড হয়।।
লীলায় নিরঞ্জন আমার
আধ-লীলা করলেন প্রচার
জানলে আপন জন্মের বিচার
সব জানা যায়।।
আপনার জন্মলতা
জানগে তাহার মূলটি কোথা,
লালন কয় শেষে কথা
হবে সাঁইর পরিচয়।।”

মহাত্মা লালন সাঁইজীর গানের ব্যাখ্যা করা আমার মতো নগন্য ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব না। সাঁইজীর গানগুলো জ্ঞানবাদের দিকদর্শনে আচ্ছন্ন। জ্ঞান আর অজ্ঞানতার পার্থক্য সর্বত্র দৃশ্যত সূক্ষ্ম তত্ত্ব, ভাবের ইন্দ্রজাল আর মুক্তির উপাদানে ভরপুর। রূপকের মোড়ক ভেদ করে গানের ভেদে পৌঁছলে এখানে আনন্দের সীমা-পরিসীমা নেই। তাই সাঁইজীর আধ্যাত্মিকতা দার্শনিক দিব্য দৃষ্টির বৈশিষ্ট্য যিনি জ্ঞাত হয়েছেন তিনি তার অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে কেবল গভীর থেকে গভীরেই ডুবতে থাকেন।
এবার গায়ক গাইলেন:

“আদি মক্কা এই মানব দেহে
দেখ না রে মন ভেয়ে
দেশ দেশান্তর দৌড়ে এবার
মরছ কেন হাঁফায়ে।।
করে অতি আজব ভাক্কা
গঠেছেন সাঁই মানুষ মক্কা
কুদরতি নূর দিয়ে;
(ও তার ) তার চারদ্বারে চার নূরী ইমাম
মধ্যে সাঁই বসিয়ে।।
মানুষ মক্কা কুদরতি কাজ
উঠেছে রে আজগৈবী আওয়াজ
সাত তলা ভেদিয়ে;
সিং দরজায় একজন দ্বারী
নিদ্রাত্যাগী হয়ে।।
তিল পরিমাণ জায়গার ভিতর
গঠেছেন সাঁই উর্ধ্বশহর
মানুষ মক্কা এ
লাখ লাখ হাজী করছে রে হজ
সেই জায়গায় যেয়ে।।
দশ দুয়ারী মানুষ মক্কা
মুর্শিদ পদে ডুবে থাকগা
ধাক্কা সামলিয়ে;
লালন বলে গুপ্ত মক্কা
আদি ইমাম মেয়ে।।”

 

আদি মক্কা এই মানব দেহে।  

 

   লালন সাঁইয়ের এই বাণীতে ভাবের গভীরতা যে কতখানি তা বলে শেষ করা যাবে না। তিনি সাধককে একটানে দেহের ভিতর নিয়ে যাচ্ছেন। সেখানেই তার কাবা এবং স্রষ্টার অবস্থান নির্দেশ করছেন। দেহতত্ত্বের রহস্য জ্ঞান না জানলে স্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রকৃত রহস্য জানা বা বোঝা সম্ভব না। আত্মদর্শনকারী ছাড়া মহাত্মা লালন সাঁইজীকে বুঝার কোন পথ খোলা নেই। লালন সুধী সমাজে,জ্ঞানী ও ধ্যানীদেরর কাছে প্রিয় সত্তা হিসেবে ইতোমধ্যেই স্থান করে নিয়েছেন। কিন্তু তার গানের রহস্য উন্মোচনের জন্য যতটুকু চেষ্টা করার দরকার ছিলো আজো আমরা তা করতে পারি নি। এ জন্য ধ্যান ও জ্ঞানের যেমন প্রয়োজন আছে তেমনই নিজেকে চেনা জানার আকাঙ্ক্ষারও প্রয়োজন আছে। আর আমরা যদি সাঁইজীর অসম্প্রদায়িক চেতনাকে উদ্ধার করে সমাজে ছড়িয়ে দিতে পারি- মনে হয় এই রক্তারক্তি কিছুটা হলেও বন্ধ হওয়ার সম্ভবনা আছে। যাইহোক আমরা প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত গান শুনে গানের পর্ব শেষ করলাম। তারপর ঐ সাধকের সাথে গানের গুপ্ত তত্ত্ব নিয়ে অনেক কথা হলো। তার প্রতিটি শব্দ যেন আমাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছিল। আমার অর্জিত জ্ঞান তার কাছে বড় অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল। আর সনদপত্রগুলোকে মুড়ির ঠোঙ্গা মনে হচ্ছিল। তবে তার ভিতর থেকে কিছু কথা টেনে বের করতে হলো। তা কখনো সুযোগ হলে পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করব।  [চলবে...]

 

লালন কী জাত সংসারে - ১ম কিস্তি

 

শাহিদুল হক

কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক।